সময়টা এমন আলস্যে সওয়ার হয়েছে যে সামান্য একটা বিয়োগ করে নিজের বয়সটা বের করবো, তাও হচ্ছে না। গুগল বাবায় ভর করে বের করলাম ৩৯ বছর ৮ মাস ১৯ দিন। কেউ কেউ বললো, খুব বেশি বয়স না, আমি আশ্বস্ত হলাম। কেউ বলল, অ্যালার্মিং বয়স, লাইফ স্টাইল খুব খুব অর্গানাইজড করতে হবে। ওয়াইফ বলল, একজন ভালো ডাক্তার দ্বারা চেক আপ করিয়ে নিলে হত না। আমি নির্লিপ্ত থাকলাম, উত্তরহীন রইলাম, ভুলে গেলাম মনে রাখার মতন করে। কিন্তু পথের ক্লান্তি, দৃষ্টির ম্রিয়মাণতা, ক্রমশ সংকুচিত সম্মুখ সময় আর চারপাশের অতি পরিচিতজনের চুপচাপ, হুটহাট চলে যাওয়া মনে তো করিয়ে দেয় আমিও ক্ষয়ে যাচ্ছি অনন্তের পথে।
এই নিশ্চিত মহাপ্রস্থানের অবিরত পথে দাঁড়িয়ে একটু পিছনে নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকানোর কথা মনে হলো। সর্বত্রই এক ধরনের অস্থিরতা, ক্লান্তি আর অনৈচ্ছিক কিন্তু আবশ্যিক প্রতিযোগিতা দেখতে পেলাম। আমার নিজের বর্তমান পজিশন আপাত দৃষ্টিতে উল্লেখ করার মত কিছু হলে কি অতীতের সব কিছু এমনি মনে হত? আমি জানি না। এক ছাত্রের কথা মনে পড়ে। আগে খুব পড়তাম। ছাত্রটির সোজাসাপ্টা মন্তব্য ছিল, ‘সারাক্ষণ তো পড়েন, কিছু হয়ে তো দেখাতে পারলেন না!’ কিছু হওয়াটা আপেক্ষিক একটা বিষয় হলেও আমাদের সমাজের গ্রহণযোগ্য বিষয়গুলো ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। ক্ষমতাই এখন ‘সাফল্য’ আর ‘কিছু হওয়ার’ মাপকাঠি। ক্ষমতার প্রতিনিধিত্বকারী পদ, অর্থনৈতিক সক্ষমতা আর সম্পর্কের জন্য তাই এত হাহাকার চারপাশে। দিন দিন সাফল্যের পথ হয়ে উঠছে ক্ষমতা লাভের বৈধ/অবৈধ রং বেরঙের অসুস্থ সব প্রতিযোগিতা। বিগত দিনের সেল্ফ অ্যাসেসমেন্টে এক ধরনের অসুস্থ জাগতিক প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়েই আমার অতিবাহিত সময় আবিস্কার করলাম। স্মৃতিচারণে যা কিছু আনন্দের, যা কিছু স্বস্তির তা ছিল ঐসব প্রতিযোগিতার ক্ষণিক বিরতিকালে প্রাপ্ত।
গত জানুয়ারিতে ট্রেকিং এ গিয়েছিলাম বান্দরবনে। জীবনের আবশ্যিক অনেক কিছু ছাড়াই কয়েকটা দিন কেটে গেল অনায়াসে। গরম পানি, আরামদায়ক বিছানা, ক্ষনে ক্ষনে চায়ের কাপে আয়েশি চুমুক ছাড়াই শীতের কয়েকটা দিন বেশ চলে গেল। কাউকে ক্ষমতা দেখিয়ে বা কারো ক্ষমতার দাপট না দেখেও তো দিব্যি সময় পার হয়ে যায়! মনে হলো, জীবনে বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। পড়ন্ত বেলায় দেবতা পাহাড় হতে ফিরছিলাম, দেখলাম মা- ছেলে সারাদিনের উপার্জন সামান্য কিছু হলুদ সংগ্রহ করে ফিরছে অথচ কী আনন্দে পরিপূর্ণ তাদের মুখ! আবার মনে হলো, জীবনে অনেক কিছুর কি খুব প্রয়োজন? সুর্যের বিদায়ী আলোর শেষ ছটা পাহাড়ের গায়ে হারিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবলাম, মহাবিশ্বের যেমন সব কিছুই প্রতিনিয়ত পরস্পর হতে দূরে সরে যাচ্ছে, আমাদের সম্পর্কের ইতিহাসও তেমনি। ভুলে যাওয়া আর দূরে যাওয়ার বৃত্তান্ত। সব হতে কত দূরে গিয়েছে জানি না, তবে মনে হয় ব্যবধান যতটাই বেড়েছে একাকিত্ব পরিসরও বিস্তৃত হয়েছে ততটাই। পরশ পাথর পাওয়ার জন্য আলকেমিস্টদের চেষ্টার চেয়ে কোন অংশে কম নয় দুরন্ত এ সময়ে আমাদের প্রচেষ্টাগুলো। যা কিছু আছে নগদে, ল্যাব টেস্টে দিব্যি লাগিয়ে দিচ্ছি প্রফুল্লচিত্তে! ফিরতি যে খুব একটা আসছে তা নয় তবু্ও সময়, সম্পর্ক অবলীলায় বাজি ধরছি জুয়ার বোর্ডে। মহা ব্যস্ততায় দিন,মাস আর বছর অনেক অনেক সংকীর্ণ হয়ে আসছে। বারেবারে স্মরণে আসে ‘আমার বেলা যে যায়‘। তবে ইদানিং বড্ড মনে হচ্ছে ফেরা প্রয়োজন; ফেরা দরকার নিজের কাছে! জীবনতো অনেক ছোট, তাই না?
আসলেই ফেরা দরকার, কারণ বৈরাগ্য সব দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেটা একজন সামাজিক মানুষ এর জন্য অসম্ভব। দায়িত্ব যেখানে মূখ্য ভূমিকা পালন করে, সেখানে বৈরাগ্য কে লুকিয়ে রাখতে হয়।