ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খুব সরু পথে পাহাড়ে উঠা শুরু হলো। দু’পাশে বড় বড় ঘাস আর বিভিন্ন লতা গুল্ম। বুনো কলার গাছ, আবার মানুষের হাতে লাগানো সেগুনও আছে। উঠতি পথে আম, কড়ই, আমলকি গাছের সাথে দেখা হলো। হতাশ হতে হলো পাখিদের অনুপস্থিতিতে। মানুষের মত পাখিরাও মনে হয় আজ শহরমুখী। খাবারের তো অভাব নেই সেখানে! পথে সাদা জংলী ফুল, মাঝে মাঝে লাল রোজেলা, বেশ ভালই লাগলো। প্রায় ২০০ মিটার উপরে এসে একটা খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে একপাশে বিস্তৃত পাহাড় শ্রেণীর দৃশ্য মন ভালো করে দিল। আমাদের আশ্রয়ের ফার্ম হাউজের নীল টিন দেখা যায়। দূরে অনেক ইট ভাটার ধোঁয়া আকাশে কালিমা ছড়াচ্ছে! একসময় পাহাড়ের গায়ে একটা রিজ লাইন ধরে এগুতে হলো, পথ হতে নেমে গিয়েছে পাহাড়ের ঢাল যেখানে দাঁড়িয়ে মেঘের আবরণের নিচে অবারিত পাহাড় দেখে চোখের যে প্রশান্তি তা অতিদ্রুত মনেও ছড়িয়ে গেল। এ অনুভূতির জন্যই হয়তো পাহাড়ে আসা যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
এরপর বেশ খাড়া পথ। ২৪০ মিটার উপরে পাহাড়ের গায়ে একটা বিশাল শিমুল গাছ যেন আকাশে পাখা মেলে আছে। পাহাড়ের খাঁজে এক জুম ক্ষেতের পাশে এসে দাঁড়ালাম। সামনে বিস্তৃত পাহাড়ের মেলায় মেঘের খণ্ড খণ্ড ছায়া! একপাশে রাঙামাটির সবচেয়ে বড় পাহাড় ফুরমোনকে ধ্যানমগ্ন দেখা যায় অন্য পাশে সীতাকুণ্ড রেঞ্জের পাহাড়গুলো। যতদুর চোখ যায় নীল পাহাড়ের ঢেউ, উপরে সাদা-ধূসর চঞ্চলা-বিক্ষিপ্ত মেঘ। তার ফাঁক গলে সূর্যালোকের দৃষ্টি গোচর হয়ে পাহাড়ে নেমে আসা অবাক চোখে বহুক্ষণ দেখলাম। যেন স্বর্গীয় কোন আলো। প্রতিটি বিচ্ছুরণ নীল সবুজ ক্যানভাসে আলাদা করে চোখে ধরা পড়ছে।
হাতিমারার শীর্ষে এসে পাখির কিচির মিচির শোনা গেল, আছে দুরন্ত বাতাস আর বুক ভরে নিশ্বাস নেয়ার মত স্নীগ্ধ অক্সিজেন। এখান হতে কাপ্তাই লেক আর রাঙ্গামাটি শহর দেখা যায়। ঠিক এভাবে ভিনদেশে ভিসুভিয়াস এর জ্বালা মুখের সামনে হতে ন্যাপলস শহর আর সাগর দেখেছিলাম। কিন্তু আজকের মাত্র ৪৩০ মিটার উচ্চতার এ মুগ্ধতা সে তুলনায় কোন অংশে কম নয়!
অসম্ভব সুন্দর ট্রেইল হতে যখন ফিরলাম তখনও আধা ঘন্টার মতো বেলা ছিল। পাহাড়ের গায়ে শেষ বিকালের রোদ সমান্তরাল ভালোবাসার স্পর্শে খেলা করছিল, আর সবুজ বিকীর্ণ হচ্ছিল যেন। চারদিকে পাখিদের ঘরে ফেরার আনন্দ উচ্ছ্বসিত কলরব। তারপর হঠাৎ করে সন্ধ্যা নামলো। সন্ধ্যা নামলো পাহাড়ে!
এখানে আযান শোনা যায় না। মাগরিবের নামাজ আদায় করে ফেললাম। সারা দিনের ট্রেকিং এর ধকল গিয়েছে শরীরের উপর দিয়ে। যদিও আজকের সুন্দরতম সব স্মৃতির তুলনায় কষ্টগুলো কিছুই না। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কমরেডগণের ডাকাডাকিতে যখন জেগে উঠলাম তখন রাত ৮.৩০। ঘর হতে বের হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অনেক দিন কোন সৌন্দর্য অবলোকনে এমন করে বিহ্বল হইনি। আকাশে তারাদের চমৎকার ঝকঝকে মেলা। উত্তর-পূর্ব পাশের পাহাড়ের মাথায় জুপিটার, তার পাশে কালপুরুষের আটটা তারা জ্বলজ্বল করছে। দক্ষিণ-পূর্বাকাশে লুব্ধক আবছায়া কানিস মেজরের মধ্যেমণি হয়ে জাজ্বল্যমান। একটু পর জেমিনি আয়তাকার শরীরে দেখা দিল আকাশে। আরো পরে লাল তারার বেশে মঙ্গল গ্রহ দিগন্তের উপরে উঁকি দিল। তার পিছু পিছু আসলো কর্কটের তারাগুলো। এ এক অনিন্দ্যসুন্দর পটভূমিতে আলোর বিন্দুগুলোর বিশাল মঞ্চে দ্বিধাহীন আবির্ভাব। যেন পরিচয় পর্ব চলমান। শহরে Air quality আর Light Pollution এর জন্য এমন বিস্ময়কর মঞ্চের মুখোমুখি হওয়ার জো নেই। কতদিন কতরাত শহরের আকাশে তারাদের এমন মিলন মেলা Explore করার অপেক্ষায় থাকতাম! মনে হতো শহরের আকাশ বুঝি অনেক উঁচুতে।
আসামবস্তি-কাপ্তাই রোড ধরে ফিরছিলাম, রাস্তার একদিকে জুরাইছড়ি-বিলাইছড়ি মিলে ছড়িয়ে থাকা কাপ্তাই লেক ঘেষা ধ্যানস্থ পাহাড় শ্রেণী। তার উপর রূপকথার সাম্রাজ্যের প্রাসাদের মতো পেঁজা তুলোর ন্যায় শুভ্র মেঘমালা নিশ্চুপ ঝুলে আছে। সামনের দিকে দুই হাতের মতো করে লম্বা দুই খণ্ড মেঘ যেন সে প্রাসাদের রাজ ফটক! ফেরার সময় অনেকক্ষণ মেঘের রাজ্যের এরূপ সৌন্দর্যে অবগাহন করছিলাম। ভালো লাগাটা এমনি বিস্তৃত ছিল যে, দুচোখের প্রশান্তি সহসায় হৃদয়ের গহীনে প্রবেশ করে তা আলোময় করে দিচ্ছিল।
সন্ধ্যার একটু আগে যখন সূর্য কাপ্তাই লেক ও পাহাড়ের গায়ে তার বিদায়ী আলোর আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে তখন হঠাৎ পশ্চিম আকাশে চোখ গেল, সেখানে নীলাভ মেঘের বিদীর্ণ দেহের মধ্যে সূর্যালোকের বিচ্ছুরণ। সন্ধ্যার পর চারদিকে ঘন অন্ধকারের চাদর দেখে মনে হলো, আলো নিভে গেলে সব বৈচিত্র্যও হারিয়ে যায়। সব রূপ, সব আকার, সব রং এক হয়ে যায়। কোথায় সে নীলাভ জল, নীল পাহাড়, রক্তিম সাজের আকাশ? সব এখন প্রাগাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত। এক, অভিন্ন আর বিতর্কহীন আঁধার।
ফেরার পথে সোলার এনার্জির ম্লান আলোয় আলোকিত টং দোকান দেখে নিজের ভিতরের একটা সুপ্ত বাসনা উঁকি দিল: এমন চায়ের দোকানে, এমন নিষ্প্রভ আলোয় এমন নির্লিপ্ততায় চা খেতে মন্দ লাগবে না। জটিলতাহীন সহজ সরল নির্মল জীবনের প্রতিনিধিত্ব কেন জানি টং দোকানটা হয়ে ওঠলো।
আপতত বিদায় পাহাড়!