Skip to main content


আজ সাত সকালে কিছু কথা, কিছু ঘটনা মনে পড়লো। মনে হলো, একি পূণ্যের মোড়কে উচ্ছ্বসিত পাপ? নাকি তথাকথিত সংস্কারের আবরণে স্বীকৃত পূণ্য?

অনেক দিন পর গ্রামে গিয়েছিলাম। অনেকের চোখে আমার অতিরঞ্জিত অবস্থানকে সেদিন প্রথম উপলব্ধি করেছিলাম। কেন আমার অতি কষ্টের কনট্রিবিউশন (সামান্য?) অনেকের মনোকষ্টের কারণ হয় তাও বোধের বারান্দায় প্রথম উঁকি দিয়েছিল। ঘটনাটা সামান্যই বলতে গেলে। পথে পরিচিত এক রিক্সায় উঠলাম। যেতে যেতে অনেক কথাই হলো রিক্সাওয়ালা চাচার সাথে। বললেন, শুনেছি সরকারি চাকুরী কর। আমি খনিক লজ্জা, খানি আড়ষ্ট, খানিক খুশিতে ইন্ডিয়ান বাংলা পুরাতন সিনেমার নায়কের মত বললাম আজ্ঞে হা। এক পর্যায়ে উনি জিজ্ঞেস করলেন, বেতন কত পাও? আমি চুপ থাকলাম। উনি বললেন, নিম্নে তো এক লাখ পাওই। আমি অসহয়ের মত হেসে বললাম, এত টাকা বেতন সরকারী চাকরিতে? খুব, খুবই বড় স্যার না হলে পাওয়া যায় না। আবার কেউ কেউ এককাঠি এগিয়ে এসে বলে, চাকরিতে তো তোমার উপরি ইনকাম কিছু আছে। নিজে না খাও সমাজের জন্য খাও। মানুষের জন্য কিছু করো। দোয়া পাবে।

কোন কোন দিন ফোনে কোন এক অতি পরিচিত জানায়, রাস্তায় তার বাইক বা ট্রাক পুলিশ ধরে থানায় নিয়ে গিয়েছে। একটু যেন ফোন করে বলে দেয় ছেড়ে। কি করে বুঝায় এ ধরনের কো অর্ডিনেশন আমার মত পাতি সরকারী চাকুরের নয়। ২০১৫/১৬ সালের দিকে যে সরকারী বাইকটা চালাচ্ছিলাম (বাইকের লাইসেন্স ছিল না শুধু অফিস আদেশ ছিল) সেটাও দুইবার থানায় নিয়ে গিয়েছিল। অফিস আদেশ দেখানোর পরও খালাস হয়নি। ২/৩ ঘন্টা ধরে তাদের এটা বুঝাতে হয়েছে যে, এটা আমার বাপ দাদার বাইক না। সরকারী বাইক। রিসিভ পেপার দিন চলে যাই।

এলাকার মসজিদের কাজ। কোন কোন সরকারি চাকরিজীবি দুই ট্রাক ইট দান করে, সেখানে গাল ভরা পদের কাউকে কাউকে এক/দুই হাজার টাকা দেয়ার জন্য হাড় কিপটের তকমা নিতেই হয়, যদিও বেচারা জানেন, কোনমতে দিনপাত করছেন তিনি। চারিদিকে যখন তথাকথিত রবিনহুড বা বনহুরের জয়জয়কার কিভাবে তিনি তার কথা বুঝাবেন। বেশি বুঝাতে গেলেই শুনতে হয়, চালাক মানুষ তো! নিশ্চয় নামে বে-নামে ব্যাংক ব্যালান্স করছে আর সাধু সাজার জন্য এসব কিপ্টেমি, আমরা বুঝি না?

একই ব্যবসা, একই মূলধন, বেচা কেনাও প্রায় এক। কারো পেট চলে না কেউবা কারউনের বরকতে ভর করে সংসার সামলিয়ে সমাজ, মসজিস মন্দির সামলায়। আর বলে সৃষ্টিকর্তা কত বরকত দিয়েছেন। দেখুন, দেখুন! ১০ হাজার টাকা বেসিকের চাকরিজীবি কিভাবে ১০ লাখ টাকা দান করে কেউ দেখিনা না যতক্ষণ লোকটা কারো ষড়যন্ত্র কিংবা সুবুদ্ধির জোড়ে কট খেয়ে পত্রিকার এক্সপ্লেনেশনে সেই সুবিধা প্রাপ্ত সমাজের বিবেকে কড়া না নাড়ে। যেন ধরা খেলেই পাপ না হলে সবার বাপ।

কারো কারো চাকরি ম্যানেজ করে দিতেই হবে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে বহু সমাজ সংস্কারকের উদাহরণ দেয় যারা পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের কত চাকরি দিয়েছে। খুব ভালো উদাহরণ হতে পারে যদি তিনি তার পৈত্রিক জমিদারিতে চাকরিটা দিয়ে থাকেন। শত মানুষের হক মারা এ সব সমাজ সংস্কারকের সুনাম আর অনুপ্রেরণার চাপে অনেককেই চারপাশের আবদার আর প্রত্যাশায় প্রতিনিয়ত চ্যাপ্টা হতে হয়।

আশেপাশের অনেক দার্শনিক মহামানব আছেন যারা রবিনহুডের থিওরি নিয়ে সর্বদা মোটিভেটেট থাকে। ফতোয়া দেয়, চুরি-চামারি আর ডাকাতি করে আশপাশের মানুষের হক আদায় কর। এতে কোন পাপ নেই। তুমিতো নিজের স্বার্থে কোন অন্যায় করছো না। কেউ কেউ আরো চিকন বুদ্ধি নিয়ে এগিয়ে আসে, দুই চারজন বর্তমান সিস্টেমের মহাপুরুষ এর পরিচয় দিয়ে বলে, তুমি কি তাদের চেয়ে নিজেকে বড় ভাব? সিস্টেমের প্রয়োজনে যা কিছু হয় তাকে অন্যায় ভাবার উপায় নেই। তারা বেশ কিছু সমার্থক শব্দের সৃষ্টি করে সুবিধাবাদীর অভিধানে স্থান দিয়েছেন যেমন, চুরি হয়ে গিয়েছে সিস্টেম লস, ডাকাতি-বৃহৎ স্বার্থ রক্ষা, খুন-দুষ্টের দমন, ঘুষ-কাজের মজুরি, নিজ স্বার্থে পদের ব্যবহার- প্রিভিলেজ, পার্সেন্ট খাওয়া-২০% পর্যন্ত ওয়ার্ল্ড-ওয়াইড জায়েজ। আরও কত কি!

মসজিদের খুতবায় নামাজ রোজা, হালাল, হারাম কত কি শুনি। দান-সদকার ফায়দা নিয়ে নাতিদীর্ঘ বক্তব্য শুনতে পাই। কিন্তু এ সা্‌হসী নির্দেশনা শুনিনি, প্লিজ কেউ অবৈধ পথে উপার্জিত টাকা মসজিদে দান করবেন না। দানের ফায়দা শুনে আর কোন রেস্ট্রিকশন নাই জেনে দুর্নীতির ৫ লাখ টাকা হতে ৫ হাজার টাকা দান করে মসজিদ ভরা লোকের আমিন আমিন ধ্বনিতে নিজের কল্যাণের দোয়া নিশ্চয় মন্দ লাগে না। মনে হয়, এ দানে সমস্ত কালিমা ৫ হাজার টাকায় মুছে যায়। আর নিষ্পাপ শিশুর পূণ্যের আত্মতৃপ্তি হারাম ইনকামকে মোটিভেটই করে।

এক ভদ্র লোক একদিন গর্ব করে বলছিলেন, একজনের বদলির তদবির করছেন তিনি, যদি সাক্সেস হন, ঐ লোক তাকে খুশি হয়ে ৩/৪ লাখ টাকা দিবে। একজন বললেন, নাহ কাজটা তো ঠিক নয়। তাঁর উত্তরটা ছিল বেশ ইন্টারেস্টিং। “বদলির মাধ্যমে আমি তো তার উপকার করছি। আর বিনিময়ে তো কোন কিছু ডিমান্ড করছি না। সে খুশি হয়ে ৩/৪ লাখ টাকা দিবে বলেছে, এতে তো ভুল বা পাপ দেখছি না। আমি তো জোর করে বা বাধ্য করে কিছু নিচ্ছি না।”

আর এক জন একদিন আফসোস করে বলছিল, এত কষ্ট করে কাজটা করে দিয়ে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা পেলাম। বোধগম্য বিষ্ময় হলো সেই কাজ করে দেয়ার জন্যই কথক লোকটি প্রতিমাসে বেতন পান। প্রত্যাশায়, মাইন্ডসেটে ব্যাপারটা কি এমন, চাকুরির জন্য বেতন আর কাজের জন্য টাকা! হয়তো তাই!

কেউ কেউ বলেই বসে, আপনি কি নবী, রাসুল; আমিতো না, আপনিও না। সব কাজ আপনার শতভাগ ঠিক? না, অবশ্যই না। তবে সব জিনিস নিয়ে এতো টানাটানি কেন? আমিও উদাহরণে, দৃষ্টান্তে, যুক্তিতে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ি। হয়তো বিতর্কে আগ্রহও হারিয়ে ফেলি আর সাদা-কালো, সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দের সমান্তরাল দুনিয়ার প্যারাডক্সে প্রবেশ করি চেতনে, অবচেতনে।

অনেকেই লালনের গান শোনায় সরাসরি কিংবা প্যারাফ্রেজিং করে কিংবা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন স্বরে:
‘পাপ-পুণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই।
এই দেশে যা পাপ গণ্য অন্য দেশে পুণ্য তাই।’


shisir mehdi

মো: মেহেদী হাসান। জন্ম করতোয়া ‍পাড়ের পুন্ড্রবর্ধনের স্মৃতিমাখা বগুড়ায়। সরকারী আজিজুল হক কলেজ হতে রসায়নে স্নাতকোত্তর। খন্ডকালীন এমফিল করছেন রুয়েটে। বগুড়ার বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রভাষক পদে চাকুরির মাধ্যমে কর্ম জীবনের শুরু। বর্তমানে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে কর্মরত। শিশির মেহ্দী ছদ্মনামে লেখালেখির শুরু করেছিলেন। প্রকাশিত বই চক্র ( ছোট গল্প) এবং নির্বাসনে আছি (কবিতা)। পানি নিয়ে একটা গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নালে। লেখালেখি, ভ্রমণ ও ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফিতে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে।

Leave a Reply