টানা তিন দিনের ছুটি। যার একদিন এ বছরের সর্বশেষ সুপার মুন দেখা যাবে বলে আকাশে বাতাসে খবর পাওয়া যাচ্ছে। সেই সংবাদ, একটানা ছূটি আর একটা নিমন্ত্রণ অন্ধের লাঠির মত অতিশয় আবশ্যিক একটা ট্যুরে শ্রীঘই পরিণতি পেল। মধ্যরাতের বাস ধরে রাঙ্গামাটি শহরে যখন নামলাম তখন সকাল ৯.৪০। সকালের প্রায় জেগে উঠা পার্বত্য শহরটি মেঘ ও রোদ্রের লুকোচুরি খেলায় তার নির্জনতা দিয়ে আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে। নিরিবিলি টাইপ নবাব ডাইন রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা সেরে ফেললাম সাথে ব্ল্যাক কফির চুমুক সকালের ক্লান্তির আড়মোড়া ভেঙে দিল। প্রথম জার্নিটা ছিল লেইক ড্রাইভ রোড অবলম্বন করে কাপ্তাই অভিমুখে। আসামবস্তি- কাপ্তাই এই রাস্তাটা বলতে গেলে অনন্য। সুদীর্ঘ এই রোডের প্রারম্ভে হলুদ-সবুজ ডোরাকাটা রেলিং এর ব্রিজ। লোকে বলে ব্রাজিল-ব্রিজ। যার একপাশে কাপ্তাই লেকের মন ভোলানো জল অন্য পাশে ফুরমোন পাহাড় দেখা যায়। আশ্বিন মাসের তীর্যক রোদে এমন সুন্দর আবহেও বেশিক্ষণ পাহাড় আর লেক দর্শন চললো না। রওনা দিলাম। এ এক বৈচিত্র্যময় রাস্তা। উচু-নিচু আঁকা-বাঁকা পথ। কখনো লেকের পাশ ঘেঁষে, কখনো টিলার পার্শ্ব বিদীর্ণ করে, কখনো দুপাশে প্রাণবন্ত সবুজ গাছ-গাছালী আর লতা-গুল্মের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে পিচ-ঢালা পথ। পথে মোরঘোনা গ্রামের পাশে লাভ ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে মনটা জুড়িয়ে গেল। সামনে কাপ্তাই লেকের ভূবন ভোলানো জলরাশি, অনেক দূরে ধ্যানমগ্ন নীল পাহাড়ের সারি। আকাশে খন্ড খন্ড সাদা মেঘ। কি অপার্থিব সুন্দর!
পথে আর একটু এগিয়ে বড়াদম বাজারের কাছে বেরান্ন্যে লেক শো ক্যাফেতে রিফ্রেশমেন্ট এর জন্য পথ বিরতি নিলাম। যতক্ষণে খাবার তৈরি হচ্ছে, হ্যামোকে শুয়ে শুয়ে আমগাছের পাতার মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলোর খেলা দেখতে লাগলাম। পাশে লেকের নীল জলরাশি, দৃষ্টির সীমায় তার সান্নিধ্যে পাহাড়! এ এক অনাবিল প্রশান্তির ছায়া শীতল ক্ষণিক অবকাশ।
প্রায় ৪০ মিনিট পর আমাদের সেই অসম্ভব রকমের সুন্দর পথে আবারও চলা শুরু হলো। বরাদম ব্রিজ পার হয়ে সবুজ অরণ্যে মোড়া রাস্তায় স্যাঁতসেঁতে মাটির গন্ধ অনেক আগে গ্রামে থাকার কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রকৃতির মনোহর নীরবতা আর নিস্তব্ধতা ঘুম পাড়ানি গান আর স্নেহের মৃদু দোলানি চালের মত শান্তি এনে দিচ্ছে যেন। আশেপাশে বনবাদাড়ে প্রকৃতির এমন ধ্যানমগ্ন সৌন্দর্যে অনেক রিসোর্ট গড়ে উঠেছে দেখলাম। কায়মনোবাক্যে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম “এ অরণ্য, এ নিস্তব্ধতা, এ অনাবিল নির্জনতায় পাখিদের আড্ডা, গান সব যেন আজীবন অক্ষুণ্ণ থাকে। আমাদের অনধিকার প্রবেশ এই ছায়ানীড়ের ছন্দময় জীবনের ছন্দ পতনের কারণ না হয়।” সবুজ আর নিরবতার এমন মিলন মেলা পার হয়ে কর্ণফুলীর পাড় ঘেঁষে চলতে লাগলাম। কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের পাশ দিয়ে এ যাত্রাটাও চমৎকার ছিল। দুপুর একটায় খাবারের জন্য কর্ণফুলী নদীর পাশে জুম রেস্তোরাঁয় বিরতি নিলাম। রেস্তোরাঁর খোলা জানালাটা ঠিক নদীর বাঁকের উপর। ওপাড়ে পাহাড় আর চা বাগান। কয়েক দিনের বৃষ্টির জন্য নদীতে দুকূল ছলকানো সুগভীর নীরব স্রোত। কেমন জানি ভয় ভয় করে! এর আগেও এখানে আসা হয়েছে। অন্যরকম বিষন্নতা মেশানো স্তব্ধতায় জড়ানো ভালোলাগা কাজ করে। দুপুরের খাবার শেষে রওনা দিলাম ওগাগগা ইউনিয়নের ফগির মরং ঝর্ণার উদ্দেশ্যে।
ওগাগগা ইউনিয়ন এর পাগলী পাড়া হতে কখনো লোকালয়ের এর মাঝ দিয়ে কখনও ঝিরিপথ ধরে এবং সর্বশেষ পাথুরে ঝিরিপথে আমাদের চলতে হলো। লোকালয়ের কয়েক জায়গায় নিশান যুক্ত সৌধের মত মাচাং দেখলাম। জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম, কেউ মারা যাওয়ার পর তার আত্মার শান্তি কামনায় এমন অস্থায়ী মাচাং এবং পাশে পথিকের জন্য জল পানের ব্যবস্থা তৈরি করা হয়। আহা মৃত্যু! তারাশঙ্কর বন্ধ্যোপাধ্যায়ের লেখা মনে পড়ে গেল, জীবন এতো ছোট ক্যানে?
দুপাশের টিলার মাঝে পাথর বিছানো ঝিরিপথ, মাঝে মাঝে বড় বড় বোল্ডারও আছে। চলতে বেশ বেগ পেতে হয়। দুপাশে ঘন সবুজ জংগল। ঝিরির জলের কুলকুল শব্দ, ক্ষণিক বিরতীতে টুনটুনি, ফিংগের মুগ্ধ স্বরের ডাক, অরণ্যের নীরবতা আর শান্ত মনে ভালো লাগার অপার্থিব অনুভবে পৌঁছে গেলাম ফগির মুরং ঝর্ণার পাদদেশে। এমন নীরবতায়, এমন মুগ্ধতায়, প্রকৃতির এরুপ শান্ত সাজ স্বজ্জায় মনে হয়, পরম আত্মার স্মরণে ডুবে যাই ধ্যানে।
বর্ষা পেরিয়ে গিয়েছে, ঝর্ণাকে তার পূর্ণরূপে পেলাম না। তবু্ও তার ঝরে পড়ার একটানা সঞ্জিবনী শব্দে মোহমুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে এই তাড়াতে ফিরতি পথ ধরলাম।
দূরে একটা পাহাড়ের উপড় একটা আশ্রয় তখন ডাকছে জোৎস্নাস্নাত রাতের প্রকৃতির কাছে সময় কাটানোর জন্য। ফিরছি সেই টানে…………..। (চলবে)