Skip to main content

এ জায়গা হতে আমাদের আজকের ট্রেকিং শুরু! সাপছড়ি উপর পাড়ায় এসে যখন শুনতে পেলাম তখন সামনের পথে তাকিয়ে খুবই অনাড়ম্বর আর সাধারণ একটা ঝিরিপথ মনে হলো। কিন্তু অনুভবটা জাস্ট কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থায়ী ছিল। ৪০/৫০ ফিট সামনে গিয়ে একটা বাঁক ঘুরতেই চকিত চিন্তায় আলোর ঝলকানির মত একটা ভাবনা উদিত হলো, অসীম রহস্যাবৃত সৌন্দর্যের দ্বার প্রান্তে আমরা।

নুড়ি বিছানো ঝিরিপথের একপাশে শুকনো আর এক পাশে মৃদু ছন্দে পানির প্রবাহ। এই দুই পথের মিলিত ঘূর্ণন গতি সহসাই অরণ্য বেষ্টিত এক পথে নিয়ে গেল। এ যেন কাল্পনিক দুনিয়ার নব নব অনুভবের বৈচিত্র্য দৃশ্যপট!  কখনও কেবলি নুড়ির কার্পেট বিছানো খরস্রোতা ঝিরি পার হতে হয়। চারপাশের নিশ্চুপ পরিবেশে ক্ষণে ক্ষণে পাখির বৈচিত্র্য কলতান। এ পথে এ আবহে ঠাণ্ডা জলে পা ভিজিয়ে  ক্লান্তিময় দেহমনে অনাবিল সজীবতার স্ফূরণ টের পাওয়া যায়। সহসাই দেহমনের অবশ মোহনা অপার্থিব সৌন্দর্যে স্পন্দিত হতে থাকে। কখনও  বোল্ডারে পূর্ণ ঝিরিপথ পাড়ি দিতে হলো। বৃহৎ পাষাণের পাঁজর আলিঙ্গন করে সবেগে প্রবাহিত হচ্ছে সুতীব্র জলধারা। মাঝে মাঝে মনোহর এ পথে দুপাশে পাহাড়ের সুউচ্চ স্পর্শ আর সবুজ গাছ-লতা-গুল্মের সমারোহ এক অজানা রোমাঞ্চকর রাজ্যে নিয়ে যায়। এমন আধো আলো আধো ছায়ায় মনে হয়, মহাকাল যেন থমকে গিয়েছে, স্থবির হয়েছে বার্ধক্য, দুঃখ, কষ্ট সব। 

কোথাও গাছ-গাছালি, পাহাড়ের দেয়াল, ঝিরির বোল্ডার এর সুপরিকল্পিত মিলন নাতিদীর্ঘ  ট্যানেলের জন্ম দিয়েছে। কেমন জানি গা ছমছম করা ভালো লাগার জন্ম দেয়! গাছ-গাছালি আর পাহাড়ের কোল হতে বিচিত্র অবয়বের আকাশ দেখা যায়। সেখানে আলো আধারির খেলা মনের সেলুলয়েডে অবিস্মরণীয় সব ফটোগ্রাফ এঁকে যায়। স্যাঁতসেঁতে পাথুরে পাহাড় স্পর্শ করলে প্রাণের কেমন জানি একটা স্পন্দন পাওয়া যায়।

পথের একটা বাঁকে একটু থামতে হলো। ট্রেইল হতে মধ্যাকাশে গমনের অপেক্ষমান সূর্য স্পষ্ট দেখা যায়। চারিদিকে সুনসান নিস্তব্ধতা। কিন্তু একটা মাত্র ছন্দময় একটানা সুর কান মস্তিষ্কের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে হৃদয়ের গোপন প্রকোষ্ঠে অনাবিল সঙ্গীতের পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। এমন শব্দহীন নীরব প্রান্তরে শুধু ঝিরিপথের জল পাথরে বুকে যে ছন্দের সৃজন করছে তার তুলনা কোন ব্যঞ্জন, একতারা,দোতারা বা গীটারের বা অন্য কোন মানব সৃজিত বাদ্যযন্ত্র এর সাথে হয় না। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম এ সঙ্গীতের মঞ্চে। সহযাত্রীর আহবানে সৎবিৎ ফিরে পেলাম। দ্রুত যেতে হবে!

জল পতনের শব্দে জানলাম, সমতল ঝিরিপথের শেষে পাহাড়ি পথ যেখানে আসন্ন সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে একসময়ের যৌবনা লাম্বা চাদারা ঝর্ণা! ২০১৭ সালের ভুমিকম্পে তার অতিকায় রুপ নামমাত্রে এসেছে। এখন এটা খুব সংকীর্ণ একটা ঝর্ণা। দূরত্ব কমার সাথে সাথে শব্দের তীব্রতাও বাড়ছে।  পাহাড়ের গায়ে সরু রাস্তা বেয়ে এবার আমাদের পথ চলা শুরু হলো। একটা কড়ই গাছের তলায় পেতে রাখা সরু কাঠের মাচায় একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য আমাদের বসতে হলো। গাছের ঝিরিঝিরি পাতার মধ্যে দিয়ে বিচিত্র আকাশের লুকোচুরির দর্শন মেলে। সামনের রাস্তার পাশে পাহাড়ের ধ্বংসাবশেষ মাড়িয়ে বেশ খানিকটা পথ নিচে নেমে দেখা মিলল লাম্বা চাদারা ঝর্ণার। তিন মানুষ সমান উচু। পানির বেগ বেশ বহাল আছে এখনো। বাতাসে জলের মায়াবী গন্ধ পাওয়া যায়।

আবার পথ চলা শুরু হলো পাহাড়ি পথে। গাছের বড় গুড়িকে কুড়াল দিয়ে চারপাশ হতে ছেটে দিলে দেখতে যেমন লাগে ২০১৭ সালের ভুমিকম্পে কোনমতো টিকে থাকা সেরকম একটা পাহাড় দেখলাম চলতি পথে। সাপছড়ি মইন পাহাড় পৌছার কিছু আগে পাহাড়ের কিনারে বসার জায়গা। কাঠের ছোট মাচা যেখানে বসে সবুজে আচ্ছাদিত সুদীর্ঘ পাহাড় শ্রেণী দেখা যায়। যতদূর চোখ যায় ঢেউ খেলানো পাহাড়! দূরে আরো দূরে চোখ ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে কিন্তু এ বিস্তৃত পাহাড় আর সবুজের সমারোহ দেখে মনের পিপাসা মিটে না। মনে হয় আরও একটু দেখি, পাহাড়ের প্রতি ভাজে, সবুজের প্রতি ঢেউ এ চোখ দুটি আর একটু প্রশান্তি খুঁজে পাক। সহযাত্রীদের ডাকে সম্মোহন হতে যেন বাস্তবে ফিরে আসলাম। একজন বলছে, আমরা প্রায় চলে এসেছি সাপছড়ি মঈন পাড়ায়। 

প্রথমে একটা ঢাল বেয়ে লোকালয়ের অগ্রভাগে চলে আসলাম। দু পাশের বসত বাড়ির মধ্যে দিয়ে চলে আর একটা ঢাল বেয়ে পাড়ার উচু বসতি এলাকায় পৌঁছালাম। এখানে ডিশ অ্যানটেনার দরুন কোন কিছুই বহির্বিশ্ব হতে দূরে নয়। মোবাইল নেটওয়ার্কও আছে। মুগ্ধ হলাম এ অঞ্চলের মানুষের আতিথেয়তা আর সরলতায়। এ সুদীর্ঘ বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এ পাড়ার ছেলে মেয়েরা স্কুলে যায় শুনে অবাক হলাম, বিস্মায়াভিভূত হলাম জীবন সংগ্রাম দেখে।

পাড়ায় সবচেয়ে উচু স্থান হতে একপাশে কাপ্তাই লেকের নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়ে অন্য পাশের প্রহরীর মত দণ্ডায়মান সু-উচ্চ হাতিমারা পাহাড়। কোন একদিন ঐ পাহাড়ে ক্যাম্পিং করার বাসনা ও সংকল্প নিয়ে নিচে নামা শুরু করলাম। 

এখানকার সবুজের মত, বাতাসের নির্মলতার মত এ পাড়ার মানুষের ব্যবহার আর সরলতা। প্রকৃতি আর মানুষের অসম্ভব সামঞ্জস্যপূর্ণ সরলতার সুতীব্র স্পর্শ হৃদয়ে নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। প্রায় এক বছর পরও সে স্নীগ্ধতার বিন্দুমাত্র ক্ষয় স্মৃতির পাতায় অনুভূত হয়না। বেঁচে থাকুক পৃথিবীর সব সবুজ, সরলতা আর নির্মলতা।

(শেষ পর্ব)

 

 

 

shisir mehdi

মো: মেহেদী হাসান। জন্ম করতোয়া ‍পাড়ের পুন্ড্রবর্ধনের স্মৃতিমাখা বগুড়ায়। সরকারী আজিজুল হক কলেজ হতে রসায়নে স্নাতকোত্তর। খন্ডকালীন এমফিল করছেন রুয়েটে। বগুড়ার বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রভাষক পদে চাকুরির মাধ্যমে কর্ম জীবনের শুরু। বর্তমানে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে কর্মরত। শিশির মেহ্দী ছদ্মনামে লেখালেখির শুরু করেছিলেন। প্রকাশিত বই চক্র ( ছোট গল্প) এবং নির্বাসনে আছি (কবিতা)। পানি নিয়ে একটা গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নালে। লেখালেখি, ভ্রমণ ও ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফিতে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে।

Leave a Reply