আশ্বিন মাসের শেষের দিকে। শরতের যাচ্ছে যাচ্ছে ভাব। তা প্রকৃতির দৃশপটে নয়, কালেন্ডারের পাতায়। এখনো আকাশ বর্ষার মত গুমোট, বিষন্ন। আমি প্রতি সকালে এক বুক আশা নিয়ে শরতের শুভ্র আকাশ দেখার প্রতিক্ষায় ঘর হতে বের হই, প্রতিবারই মন আমার স্থবির হয়ে যায় ধুসর আকাশ দেখে। দেশে কি ঋতু চক্র থেমে গেল? তাইতো। যখন বর্ষার জন্য মন, প্রকৃতি তৃষ্ণাতুর হয়ে ওঠে, ক্যালেন্ডারের তারিখে একে একে পার হতে থাকে আষাঢ়, শ্রাবনের দিনগূলো, তখনো ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলে তপ্ত আকাশ, ঝলসানো বাতাস আর ঘর্মাক্ত দিন।
অন্তত শরতের মেঘের রাজ্যে মনকে উড়িয়ে দিয়ে কটা দিন কাটাতে চেয়েছিলাম। অপেক্ষা করছি, যখন চারদিকে অন্ধকার নেমে আসছে সকাল বেলার সূর্যের আলোর বদলে। সংশয় থাকে, এ আবহাওয়া হয়তো আবার জাম্প করে কুয়াশার রাজ্যে চলে যাবে। সকাল হতেই আকাশে বাতাসে শীতের গন্ধ পাচ্ছি। শরীরে কাটা দিচ্ছে ভোরের বাতাস। দীর্ঘদিনের লালিত প্রেডিকশনগুলো ঠিকমতো যেন কাজ করছে না। প্রত্যাশার বহুল পরিচিত স্ক্রিপ্ট গুলো বারে বারে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে নতুন করে ভেবে লেখার তাগিদ দিচ্ছে যেন সবখানেই। কি প্রকৃতিতে! কি পরিবারে! কি সমাজে ! ………।
আমার নানা শিক্ষক ছিলেন। তাকে দেখে, তাঁর ছাত্রদের মুখে গুরু বন্দনা শুনে আমারও এ পেশায় অদেখা টান তৈরি হয়েছিল। টিউশনের মাধ্যমে হাটি হাটি পা পা করে এ জগতে আমার যাত্রা। চিন্তায়, বোধগম্যতায়, স্মৃতিতে আমার মুগ্ধতার ছায়া। পরবর্তীতে একটা স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রভাষকের চাকুরি পাওয়ায় শিক্ষকতা পেশায় প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে চলে আসি। চাকুরীটা পাওয়ার অন্যতম কারণ হিসাবে এখনো আমার মনে হয়, ভাইভা বোর্ডে আমার অন্তর হতে শিক্ষকতা পেশাটাকে কতটা ভালোবাসি, এ কাজে আমি কতটা নিবেদিত প্রাণ তা বোঝাতে সমর্থ হয়েছিলাম। সেদিন ভাইভা বোর্ডে যা বলেছিলাম সেখানে এতটুকু প্রপঞ্চ ছিল না। সব টুকুই সত্য।
নিজে পড়ার জন্য, পড়ানোর জন্য এ যে শিক্ষকতা পেশায় প্রচণ্ড আত্মতৃপ্তি নিয়ে আমার প্রবেশ তা শ্রীঘ্রই সকল প্রেডিকশনের মাথায় বেশ জোরে সোরে ঝাঁকুনি দিল। নিরীহ গোছের সংকল্প তাড়াতাড়িই বৃত্তবাসনা কাছে পরাস্ত হলো। ধীরে ধীরে শিক্ষকতার কর্পোরেট সুবিধার মজা পেতে শুরু করলাম। প্রতিটি অবসর সমর্পণ কললাম নগদ আর্থিক লাভের কর্মকাণ্ডে। মনে পড়ে, এ চাকুরিতে যোগদানের সময় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য জেলা সিভিল সার্জন অফিসে যেতে হয়েছিল। সিভিল সার্জন মহোদয় টিচিং প্রফেশনে যাচ্ছি জেনে বেশ সম্মান করে বসতে বলেছিলেন। তার আন্তরিকতা ছিল মুগ্ধ হওয়ার মতো। আমার ছাত্র অবস্থায় শিক্ষকতার যে অবয়ব কিংবা নানার স্মৃতিচারণে বা তাঁর ছাত্রগণের বর্ণনায় এ পেশার যে ল্যান্ডস্কেপ আমার সামনে ছিল, বাস্তব জীবনে তা কেন জানি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অতি সত্ত্বর স্বপ্ন আর বাস্তবতার দ্বন্দ প্রকট হয়ে ওঠে। আমি মাছের খাবি খাওয়ার মতো করে হাফ ছেড়ে বাঁচার পথ খুঁজছিলাম। পেয়েও গেলাম। হঠাৎ নতুন অধিক্ষেত্রে চাকর হওয়ার সুযোগ জুটে গেল। মা বললেন, বেশ তো আছিস বাবা মাস্টারিতে! কি দরকার চেঞ্জ করার? বললাম না মা, যাই চলে।
নতুন চাকরির স্বাস্থ্য পরীক্ষার চিঠি পেয়ে ঢাকা অভিমুখে ছুটে চললাম। চিঠি মর্মানুসারে একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিভিন্ন পরীক্ষা নীরিক্ষা করিয়ে নিয়ে নির্ধারিত মেডিক্যালে গেলাম। স্মৃতিতে আমার সিভিল সার্জন অফিসের সুখকর স্মরণ। নির্দিষ্ট কক্ষে অপেক্ষা করার পর এক ভদ্রলোক আসলেন। একটা ফরম দিলেন পূরণ করার জন্য। আমি পূরণ করে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টসহ জমা দিতে গেলাম। ভদ্র লোক উদার ভাবে বললেন, এতসব পরীক্ষার দরকার ছিল না। পরক্ষনেই সম্পূর্ণ অযাচিতভাবেই বললেন, ২০০০/- টাকা দিন। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, টাকা দিব কেন? ভদ্রলোক নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, বারে, আমি আমার কাজ ছেড়ে আপনার কাজে এসেছি। আপনি টাকা দিবেন না?
আমি বললাম, আমার কাছে ২০০০/- টাকাই আছে। এটা দিলে আমি বাসায় ফিরবো কি করে? লোকটা জিজ্ঞেস করলেন, বাসা কোথায় আর ভাড়া কত? বললাম।
লোকটা বললো, আচ্ছা ৫০০/- আপনার কাছে রেখে বাকিটা দিয়ে দিন।
আমি সুবোধ বালকের মত ১৫০০/- টাকা দিয়ে দিলাম। জীবনে খুব কম সময়ই আমি এতটা অবাক হয়েছিলাম।
নতুন চাকুরিতে প্রথমে হেড অফিসে পরে জেলা কার্যালয়ে জয়েন করলাম। দুই মাসের বেতন তোলা যায়নি। হিসাবরক্ষক অফিসে বিভিন্ন কাগজপত্রের চাহিদা। আমিও সাধ্যমত যোগান দিলাম। কাজ হলো না। কোন পেপার্স না থাকলে বলে নেই সরবরাহ করলে বলে উপযুক্ত চ্যানেল হয়ে আসেনি। এরমধ্যে ঈদ আসন্ন। আমি ধৈয্যের চরম পর্যায়ে পৌছালাম। আমাদের অফিসের এক স্টাফকে বললাম, কি করা যায় বলেনতো। উত্তর পেলাম, এক দেড় হাজার টাকা দিয়ে দিন, ঠিক হয়ে যাবে। নতুন চাকুরিতো! ওদেরও একটা প্রত্যাশা থাকা। আমি আবার হোঁচট খেলাম, নিজের চাকুরির বেতন নিতেও প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে?
এলাকার মফিজ মিয়া। কৃষি কাজে দশ গ্রামে তার সুনাম। ইদানিং কেন জানি তার কাজে ভালো করতে পারছে না। তো গেলেন এক কৃষিবিদের কাছে পরামর্শ নিতে। বললেন, কয়েক যুগ ধরে তার পরিবার অর্গানিকভাবে সুনামের সাথে কৃষি পণ্য উৎপাদন করে আসছে। কিছুদিন ধরে কেন জানি উৎপাদন ভালো হচ্ছে। ফসলের তুলনায় আগাছা আর ঘাস বেশী হচ্ছে। সাথে নাম না জানা বিভিন্ন পোকার উপদ্রব শুরু হয়েছে ।বড় সমস্যা হলো অনেক ক্ষেত্রের আগাছা আর ফসলের গাছ আলাদা করা যায় না। যা আশা করা হচ্ছে তার অর্ধেকও ফসল ঘরে তোলা যাচ্ছে না। আবার কেমিক্যাল ব্যবহার করলে অর্গানিক পণ্যের ট্যাগও ধারণ করা যাবে না ।
বেচারা কৃষিবিদ! উনি নিজেও মফিজ মিয়ার আর্গানিক পণ্যের একজন নিয়মিত ক্রেতা। সব শুনে তিনিও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পরের দিন কৃষিবিদ মফিজ মিয়ার খামারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ হাজির হলেন। সব কিছু পরীক্ষা করে রায় দিলেন সমস্যা আসলে বীজের মধ্যে। ফসলের বিজের প্রতিটি প্যাকেটে আগাছা আর ঘাসের বীজ পাওয়া গিয়েছে!
কি প্রকৃতিতে! কি পরিবারে! কি সমাজে ! এমনি বিধ্বংসী বীজ কি লুকিয়ে আছে যার জন্য কোথাও প্রেডিকশন কাজ করছে না। হয়তো হবে। আমি বিজ্ঞানী, জ্ঞানী কিছুই নই। নিশ্চিত করে বলতে পারছি না তাই।