Skip to main content

সময়টা ভোর না বলে শেষ রাত বলাই ভালো। নভেম্বরের ঢাকায় ৬ টার এর পরে সূর্য ওঠে। আমি এয়ারপোর্টে রেলস্টেশনে যখন নামলাম তখন ৪.৪০ বাজে। সূর্যের অনুপস্থিতির যেকোন সময়, কি সন্ধ্যা, কি শেষ রাত, কি মধ্যরাত, কি ভোর, ঘরের বা স্টেশনের বাইরে পা দিতে গেলেই মনে হয় স্বাপদসংকুল পথে নামতে হচ্ছে। লাগেজ, ওয়ালেট, মোবাইল সর্বোপরি নিজেকে হারানোর ভয়! কোথায় কোন বিপদ কেমন করে ওত পেতে আছে জানে না কেউ।
সে সংশয়ে রাস্তা ঘাট আর একটু পরিস্কার হওয়ার প্রতিক্ষায় স্টেশনে পায়চারি করতে লাগলাম। নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নির্ধারিত জায়গায় গেলাম। সেখানেও চোর সম্পর্কে সতর্কবাণী!
অনেক জায়গায় তখনো আযান হচ্ছে। সুবেহ সাদিক কি অদ্ভুত রকমের সুন্দর! পূর্বাকাশের কোণায় এক চিলতে চাঁদ।সকালের ঠাণ্ডা বাতাস নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে সজীবতায় পুলকিত করছে। তারাগুলো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে আগমনী আলোর মাঝে। আমি আলো ফোটার অপেক্ষায় প্ল্যাটফর্মে আবারো কয়েক চক্কর দিলাম। স্টেশনের সরগরম বাড়ছে। স্পিকারে শোনা যাচ্ছে, ‘’ ঢাকা হতে ছেড়ে আসা……..: লোকজনের প্রাণচাঞ্চল্য বাড়ছে। প্ল্যাটফর্মের কিনারায় দাঁড়িয়ে পড়ছে, আগত ট্রেনের ভাবী যাত্রীগণ।


সুর্য উঠার প্রাক্কালে স্টেশন হতে বের হলাম। একটা লোকাল বাসের স্টাফ তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকছে, মিরপুর মিরপুর, ইসিবি,..…………। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে লাফিয়ে উঠলাম। বাসের জানালা দিয়ে পূর্বাকাশে চোখ গেল- ধূসর আকাশে রক্তিম আলোর খেলায় নিজের আবির্ভাবের আগাম বার্তা জানান দিচ্ছে সূর্য। বাস স্টার্টের উপর দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় ছেড়ে দেবে দেয় না। একটু অ্যাক্সিলারেটর চাপ দেয়, আবার ব্রেক। এ দোলা চালে হেঁটে আসা যাত্রীরা দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠে। গাড়ি কিন্তু এভাবেই থাকে। এ এক পিকিউলিয়ার মোনাফেকি! প্রায় আধা ঘন্টা পর, অনেক ক্লান্ত, ঘুম জাগা যাত্রীদের বিরক্তি একটা পর্যায়ে নিয়ে এসে বাস ছাড়লো।

ইসিবি চত্ত্বরে যখন বাস হতে নামলাম তখন আমাদের সুপারহিরো পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাস্তা- ফুটপাতের জঞ্জাল সাফ করছে। ফুট ওভার ব্রিজে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আধখাওয়া সিগারেট, চিপসের ছেঁড়া প্যাকেট, খালি সফট ড্রিংকের বোতল, ঝালমুড়ির প্লাস্টিক কাপ! মনে হলো, একটা সমাজের লাইফ স্টাইলের প্রতিনিধিত্ব করে তাদের জীবনের উচ্ছিষ্ট। ফুটপাত, রাস্তায়, ওভারব্রিজে গত রাতের আড্ডার একটা চিত্র পাওয়া যাচ্ছে।রাস্তার পাশের রেস্তোরাঁগুলো খুলতে শুরু করেছে, কড়া মশলার গন্ধ আর বাসন মাজার শব্দ পাওয়া যায় অনায়াসে। যানজটের শহরে ভীড়হীন রাস্তাঘাট পার হয়ে আসি নির্ঝঞ্জাট। ভাবতেই অবাক লাগে- একটু পর এখানে লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে!

সকাল ৮.০০ টায় অফিসিয়াল প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য বের হলাম। এ এক অস্থির শহর! বাস ভর্তি লোক। তারপরও যাত্রী ডাকছে, লোক উঠছে, উঠতেই হবে, যেতেই হবে। বাইকার ডাকছে। রেস্তোরাঁয় কাস্টমার ডাকছে, আর গড়্গড় করে খাবারের আইটেম বলছে। কেউ অপেক্ষা করছে, কেউ দৌড়াচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গার্ডিয়ানরা ছুটছে, সাইকেলে, রিক্সায়, জীপে, মাইক্রোতে, বাসে কিংবা হেটে। অদ্ভুত বিষয় হলো কারো চোখে মুখে সজীবতা নেই যেন এক প্রকার, ক্লান্তি, তাড়া, অনিশ্চয়তা সেখানে।
মনে একটা প্রশ্ন জাগলো- প্রায় সাড়ে ছয় বছর ঢাকায় থেকে চলে যাওয়ার পর আবার ঢাকায় এসে এ দৃশ্য প্রথম চোখে পড়ল কেন? সম্ভাব্য উত্তর- আগে আমি ক্লান্তিময় এ সিস্টেমের মধ্যেই বাস করতাম কিংবা সব সময় এত তাড়া থাকতো আশেপাশের কাউকে বা কোন কিছুই খেয়াল করার ফুসরত পাইনি। কোথায় যেন পড়েছিলাম, সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেমকে দেখা যায় না, বোঝাও যায় না। মনে হয়, এ ঢাকায় আবার আসি বারেবারে- অতিথি হয়ে, সিস্টেমের বাইরের মেহমান হয়ে এর বৈচিত্র্য দেখতে।

এক সময় সাভার হতে কারওয়ান বাজার অফিসে যেতাম। প্রায় দিন সন্ধ্যায় অফিস হতে বের হয়ে ফার্মগেটে বাসে ওঠা রীতিমতো লড়াইয়ের বিষয় ছিল। একদিন তো যুদ্ধ শেষে বাসের গেটে দাঁড়ানোর জায়গা পাওয়ার পর দেখলাম এক পায়ে জুতো নেই!
কোন এক সন্ধ্যায় অফিসের প্রচণ্ড ক্লান্তিকর কাজ শেষে বাসের পিছু পিছু দৌড়ে যখন বাস পাচ্ছিলাম না, মাকে খুব মনে পড়ছিল সে সময়গুলোতে। গলা ফাটিয়ে মাকে বলতে ইচ্ছে করছিল- মা তুমি কি জানো, তোমার ছেলে রোজ বাসের পিছু পিছু দৌড়াই। দৌড়াতে হয়। আজ হঠাৎ সে কথাগুলো মনে পড়ে গেল, বোধহয় অবসর ছিল স্মৃতি রোমন্থনের!

ইসিবি চত্বরে আমাদের অফিসের রুট গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আগে কখনো বসিনি কোথাও। আজ যাত্রী ছাউনিতে একটু ফাঁকা জায়গা পেয়ে বসে পড়লাম। আগে কি ছিল ফুটপাতে এমন বসার জায়গা? মনে পড়লো না। গাড়ি আসার নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় থাকাকালীন এমন ঘটনায় এক প্রস্থ কল দিয়ে ফেলতাম। আজ কেন জানি মনেও আসলো না। আশপাশের টানা-পোড়েন যদি না থাকে কিংবা যদি আমলে না নিতে হয় কিংবা গুরুত্ব না দিতে হয় তবে এরকম রিলাক্স মুডে থাকাই যায়। মূলত অফিসকে অফিসেই রাখার মাইন্ডসেটই পারে রাস্তা ঘাট বাড়িতে সাবলীল একটা সময় আমাদের জন্য বরাদ্দ করতে। এখানে একটা ‘যদি’ আছে- যদি কেউ অসময়ে নাচতে বললে না নাচতে চাওয়ার সৎ সাহস থাকে।


ঢাকা ছাড়ছি নভেম্বরের অনিন্দ্য সুন্দর সন্ধ্যায়- টেকনিক্যাল মোড় হতে। গাড়ি একটু এগিয়ে গিয়ে গাবতলিতে যাত্রী উঠানোর জন্য একটু থামল। সামনেই তুরাগ নদীর উপর ব্রিজ। আকাশে চোখ গেলো আমার। ঢাকার আকাশ আজ কি সুন্দর! বিচ্ছিন্ন নীলাভ মেঘের জালির মধ্য দিয়ে সুর্যের রক্তিম আভা। যেন নীলাকাশে জাল বুনেছে মেঘ। ছোপ ছোপ সাদা মেঘ, তার ফাঁক গলে সূর্যের শেষ আলোর রক্তিম বিচ্ছুরণ!
এ দূষিত ভয়ানক স্বার্থের শহরে দু-দণ্ড শান্তি খুঁজেই নেয়া যেতে পারে এমন আকাশ-মেঘের ক্যানভাসে। হঠাৎ অভ্যাসবশত ফোনের ক্যামেরা অ্যাপসে আঙুল চলে গেল। একটা ভাবনায় নিবৃ্ত্ত হলাম- আজকাল মানুষ বোধহয় কিছু দেখতে যায় না, দেখাতে যায়। কোন সৌন্দর্য অবলোকন করতে যায় না, ক্যাপচার করতে যায়। পারস্পারিক বন্ধনকে রিনিউ করতে নয়, বরং দূরত্বটাকে এক প্রকার আত্মতৃপ্তি নিয়ে নতুন ব্যাকগ্রাউন্ডে ফেলতে চায়। কোথাও যায়- প্রকৃতির বিশালতায় নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে নিজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নতুন স্পন্দনের অনুরণন তুলতে নয় বরং প্রকৃতির ঘাড়ে নগরের বর্জ্য নিক্ষেপের তৃপ্তি নিতে।


বহুদিনের জানা কথাগুলো কেন জানি এ ফিরতি পথে আবার মন পড়লো।

shisir mehdi

মো: মেহেদী হাসান। জন্ম করতোয়া ‍পাড়ের পুন্ড্রবর্ধনের স্মৃতিমাখা বগুড়ায়। সরকারী আজিজুল হক কলেজ হতে রসায়নে স্নাতকোত্তর। খন্ডকালীন এমফিল করছেন রুয়েটে। বগুড়ার বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রভাষক পদে চাকুরির মাধ্যমে কর্ম জীবনের শুরু। বর্তমানে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে কর্মরত। শিশির মেহ্দী ছদ্মনামে লেখালেখির শুরু করেছিলেন। প্রকাশিত বই চক্র ( ছোট গল্প) এবং নির্বাসনে আছি (কবিতা)। পানি নিয়ে একটা গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নালে। লেখালেখি, ভ্রমণ ও ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফিতে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে।

Leave a Reply