Skip to main content

রাত ১০ টা হবে। হঠাৎ নজরে পূর্বাকাশে বেশ উজ্জ্বল তারা দৃশ্যমান । আরে সুন্দর তো! কি হতে পারে? হাতে থাকা অ্যান্ড্রয়েড ফোনের স্কাই ম্যাপ অ্যাপস এ মূহূর্তে আঙ্গুল চলে গেলো। দেখলাম আমাদের গ্রহরাজ বৃহস্পতি ওটা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বারান্দায় টেলিস্কোপ স্টেটআপ করে ফোকাস করলাম। আর তাইতো! জুপিটার! সাথে তার ৪ টা বাচ্চাও (উপগ্রহ) দেখলাম। কি অবলীলায় ! কি সহজতায়! কি কষ্টহীন প্রচেষ্টায় দেখে ফেললাম। এরপর লক্ষ্য করলাম উত্তর-পূর্ব আকাশে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ উঠেছে। দুরবীনে মায়াবী চাঁদের অমসৃণ পৃষ্ঠের গর্তসমূহ বেশ লাগলো। মুন ম্যাপ হতে জানা শুকনো সমুদ্রও দেখলাম। মনের অন্দর মহলে উঁকি দিয়ে দেখলাম, কি নিদারুণ নির্লজ্জ আত্মতৃপ্তি সেখানে। বোদ্ধাগণের লেখায় জানা যায়, গ্যালিলিও মাত্র ২০ গুণ সক্ষমতার টেলিস্কোপ দিয়ে জুপিটারকে তার বাচ্চাসহ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ যাবৎ জুপিটারের চারপাশের বিন্দুগুলোর অরবিট পর্যবেক্ষণ করে বুঝেছিলেন ওগুলো বৃহস্পতির চাঁদ। আমাদের চাঁদের পিঠের গর্তগুলো আর তার পার্শ্বে সৃষ্ট পর্বতমালাও পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। টেলিস্কোপে শুধু পর্যবেক্ষণ করেই ঐ পর্বতগুলোর সম্ভাব্য উচ্চতা পরিমাপ করেছিলেন। পর্যবেক্ষণসমূহ ড্রয়িং করে তার বিখ্যাত Sidereus nuncius (ল্যাটিন) / The Starry Messenger (ইংরেজী) বইয়ে প্রকাশ করেছিলেন সমাজে বিদ্যমান দীর্ঘদিনের অ্যাজামশনকে উল্টিয়ে । উল্লেখ্য আমি ৪৫ গুন সক্ষমতার (১৮৯ গুন পর্যন্ত বাড়ানো যায়) টেলিস্কোপ নিয়ে ৮০০ বছর আগের গ্যালিলিও এর আবিস্কারগুলো পর্যবেক্ষণ করি তাও আবার ১৫ বার ইন্টারনেট আর ১৬ বার বিভিন্ন বই পুস্তকের সহায়তায়! ৩০ মিনিট পর্যবেক্ষণকালে টেলিস্কোপের মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম ৩/৪ মিনিট, বাঁকি সময় ব্যয় করেছিলাম নিজের দেখাকে বোঝার জন্য তথ্য সহায়কের মাঝে।

ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফিতে আমার ছোট বেলা হতেই আগ্রহ। সে সময়, চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত, ক্যামেরা কেনার সামর্থ্য হয়নি। ধার করা ফিল্ম ক্যামেরায় দুই একবার বড় ক্যানভাসে ছবি তোলার প্রয়াস ছিল। জাস্ট এতটুকু। পরে এটা শুধু স্বপ্নেই ছিল। চমৎকার সব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি উঠিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিব। তো কি প্রয়োজন? ভালো ‍আর বেস্ট কনফিগারেশনের একটা ডি এস এল আর ক্যামেরা কেনা খুব দরকার, না হলে কত ভালো ছবি তোলার সুযোগ হাত ফসকে চলে যাচ্ছে। অবশেষে কেনাও হলো। ছবি তোলাও শুরু করলাম। প্রায় সাত বছর পর আমার তোলা ছবি অভিজ্ঞগণকে দেখাতে শুরু করলাম, জানতে পারলাম, তাকানো আর দেখা এক নয়। ভালো ছবি তুলতে দেখতে শিখতে হয়। শুধু তাকানো না। বিগত সময় ইচ্ছে মত শাটার চেপে ছবি তুলেছি। একবার কোন দৃশ্য ক্যামেরা বন্দি করে হার্ডডিস্কে সঞ্চিত করার পর সে ছবি আর কখনও দেখা হয়নি। এতোদিন পর এটাও জানতে পারলাম আসলে ক্যামেরা ধরাও আমার পারফেক্ট না। বড় ফ্রেমে ছবি তাই বাঁকা ওঠে। আজ যাচাইয়ের কষ্টি পাথরে মনে হয়, এত দিন শুধু তাকিয়েই ছবি তুলেছি দেখে নয়। আর তাইতো আমার তোলা এবং আমার কাছে সবচেয়ে ইম্প্রেসিভ ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফ পাবলিক গ্রুপে ১০ টাও রিঅ্যাক্ট পায় না! তারপর মনের কোণে উঁকি দেয়, ফুল ফ্রেমের একটা ক্যামেরা নিলে, মনে হয়, ভালো ছবি আসবে! শুনেছি সনি ব্র্যান্ডের ক্যামেরা স্ট্যানিং কালার দেয়! গুণি জন বলেন, ভালো ছবি তুলতে ভালো ছবি দেখতে হবে। তাকানোকে দেখাতে বদলাতে হবে। নিজের তোলা ও অন্যের তোলা ছবি খুটিয়ে দেখতে হবে। সে সুযোগ আর সময় কই? শুধু চাওয়ার বেলায় দিগন্ত প্রসারী আর চেষ্টায় যাচ্চে তাই।


সংবাদ পড়লাম, ঢাকায় নিজ বাড়ির ছাদে বসে ওরিয়ন নেবুলার চমৎকার ছবি উঠিয়েছেন জুবায়ের কাওলিন নামের এক অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফার। এক ছবি ক্যাপচার করতেই ব্যয় করেছেন ৪.৫ ঘন্টা! দীর্ঘদিনের শখের টেলিস্কোপ দিয়ে আমিতো গত ৩.৫ বছরে টোটাল ৪.৫ ঘন্টাও আকাশ পর্যবেক্ষণ করিনি। আর ঢাকায় থাকা কালে লাইট পলিউশনের দোহায় দিয়ে টেলিস্কোপই বের করতাম না। যতসব ওজুহাত! এক ড্যানিস ভদ্র লোকের সাথে বেশ কিছু দিন কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। বিদায় বেলায় তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, অনেক কিছুই তো শেখালে, আমাদের এখান থেকে কি শিখে গেলে? ভদ্র লোক অনেক কথার সাথে বলেছিল, তোমাদের একটা থার্ড হ্যান্ডও রয়েছে, এটা একটা বেশ ইন্টারেস্টিং লার্নিং!


ডাটা অ্যানালাইসিস এ বেশ আগ্রহ বোধ করলাম এক সময়! ( পরে সেল্ফ অ্যাসেসমেন্টে বের হয়েছিল, আশপাশের স্কলার লোকজনের পেপার পাবলিকেশন আর এমফিল/পি এইচ ডি এর সংবাদে খানিক ঈর্ষা, খানিক মোহ এ আগ্রহটা সৃষ্টি করেছিল। ন্যাচারাল কোন টান না)। তো কি করা যায়! পরিচিত বিভিন্ন জ্ঞানী গুনী জনের কাছে ধর্না দেয়া শুরু করলাম। ডাটা কিভাবে বিশ্লেষণ করতে হয়? কি সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হয় ইত্যাদি! যে জ্ঞান পেলাম যথেষ্ট মনে হলো না। এক কলিগ এস পি এস এস এর সাথে বেসিক পরিচয় করিয়ে দিল। নাহ! এভাবে হবে না, ভাবলাম। একটা অ্যাডভান্সড কোর্স করতে হবে, সংকল্প করলাম। সুযোগ পেয়েও গেলাম। দুই মাসের ডেটা অ্যানালাইসিস কোর্স! সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস। প্রতি দিন গড়ে তিন ঘন্টার মত। প্রথম দুই/তিন দিন একটু তাল মেলাতে পারলাম। পরে সময়ের অভাবে আল আলস্যে খেই হারিয়ে ফেললাম। নিজের উপর রাগ হলো খুব। নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য মান্না দের একটা গান মনে করিয়ে দিলাম, ক’ফোটা চোখের জল ফেলেছো যে তুমি ভালোবাসবে/পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে কি করে এখানে তুমি আসবে!

 
সোশ্যাল মিডিয়ার রিলসকে বেজ করে স্বপ্ন দেখা যেতে পারে বাস্তবায়ন তো আর ফিফটি নাইন সেকেন্ডে হয় না!


সাত সকালে এসব সাত পাঁচ ভাবতে মনে হলো, কি হবে এত যন্ত্রপাতি, ল্যাব নিয়ে কিংবা এত বই পুস্তক আর তথ্যের ভান্ডার বগল দাবা করে কিংবা সার্টিফিকেট এর তাবিজ গলায় ঝুলিয়ে যদি না সেগুলোর ম্যাক্সিমাম ইউটিলাইজেশন সম্ভব না হয়। অস্ত্র ভান্ডারের আত্মতৃপ্তি নিয়ে যুদ্ধ কৌশল আর বুদ্ধির নিবিড় চর্চাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো যে ঠিক নয় তাত্ত্বিকভাবে তো মেনেই নিতে পারি। জীবনের থিওরিটিক্যাল ভাবনা তো তাত্ত্বিক ক্লাসের মতো অতো কঠিন না। তাই না?

 
পুনশ্চ: গোরান ক্রপের ঘটনা মনে পড়ে গেল। এক সুইডিশ ভদ্র লোক। ১৯৯৫ সালের অক্টোবরে বাইকেলে চেপে ১০৮ কেজি ওজনের খাবার আর গিয়ারের বোঝাসহ স্টকহোম ছাড়ে। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে তার গন্তব্য নেপালের এভারেস্ট বেজ ক্যাম্পে পৌঁছে যান। তিনি মে/১৯৯৬ মাসে কোন এক্সট্রা অক্সিজেন আর শেরপার সাহায্য ছাড়াই এভারেস্টে সামিট করেন। আবার বাইসাইকেলে চেপে সুইডেনে ফিরেন। বান্দা একজন!

shisir mehdi

মো: মেহেদী হাসান। জন্ম করতোয়া ‍পাড়ের পুন্ড্রবর্ধনের স্মৃতিমাখা বগুড়ায়। সরকারী আজিজুল হক কলেজ হতে রসায়নে স্নাতকোত্তর। খন্ডকালীন এমফিল করছেন রুয়েটে। বগুড়ার বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রভাষক পদে চাকুরির মাধ্যমে কর্ম জীবনের শুরু। বর্তমানে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে কর্মরত। শিশির মেহ্দী ছদ্মনামে লেখালেখির শুরু করেছিলেন। প্রকাশিত বই চক্র ( ছোট গল্প) এবং নির্বাসনে আছি (কবিতা)। পানি নিয়ে একটা গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নালে। লেখালেখি, ভ্রমণ ও ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফিতে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে।

3 Comments

  • sumi says:

    কল্পনা এবং বাস্তব এর সমন্বয় অনেকটা কঠিন। তবে লেখার ধরনটা অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে, ভালো লাগছে পরিবর্তনটা।

  • Forkan says:

    লেখার ধরনটা সুন্দর। পড়ার সময় শান্তি শান্তি লেগেছে। গল্পের শেষে গোরান ক্রপের অবতারণা ভালো লেগেছে।

  • Forum says:

    শিশির মেহ্দীর লেখার ধরনটা সত্যিই সুন্দর। পড়ার সময় মনে শান্তি এসেছে। গল্পের শেষে গোরান ক্রপের অবতারণা বেশ আকর্ষণীয় ছিল। লেখার মধ্যে কল্পনা এবং বাস্তবের সমন্বয় দেখে মুগ্ধ হলাম। আপনার লেখার ধরন পরিবর্তন হয়েছে, এটা ভালো লাগল। ভ্রমণ ও ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফিতে আপনার আগ্রহের কথা জানতে পেরে আমি খুবই আগ্রহী। আপনি কি ভবিষ্যতে আপনার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনো বই লিখবেন?

Leave a Reply to sumi Cancel Reply