পাপ কি জলের মত প্রবাহিত হয়? অন্যায়গুলো কি কলঙ্কের তীলক হয়ে শোভা বর্ধন করে প্যাসিভ সুবিধাভোগীর কপালে? আজ সাত সকালে এমনি চিন্তার স্পিন বলে বোল্ড আউট হওয়ার দশা আমার।
পৃথিবীতে যত লোভ মোহ আছে খ্যাতির মত দুর্দমনীয় টান কোনটার নেই। আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ গোছের এ খ্যাতির টান এমনি ভালো মানুষের ক্যামোফ্লেজে হয়ে থাকে যে, খোদ শয়তানও দ্বিধায় ভোগে। সন্তানের কাছে, বৌ এর কাছে, সমাজের কাছে, অফিস বসের কাছে এই যে ভালো মানুষের সার্টিফিকেট পাওয়ার হাহাকার তা আমাদের ভিতরে অন্যায়ের নিষেধ করার ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। কোরানের আল্লাহ পাক বর্ণনা করেছেন, তোমার সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ কর। বস আমাকে এতো ভালো বলেন তার অন্যায়টাকে কিভাবে অন্যায় বলি, সমাজের লোকজন আমাকে এত সম্মান করে, অন্যের প্রতি তাদের জুলুমকে কিভাবে নাজায়েজ বলে ফতোয়া দেই, বন্ধু আমার এত উপকার করে, আমার সততাকে ফুলে-ফেঁপে প্রচার করে, তার ঘুষ বাণিজ্যকে কিভাবে বলি, এটা ঠিক না।
সব কিছুই নিজের আত্মতৃপ্তিকে টেকসই করার জন্য। আমি সৎ, কোন ঘুষ খাইনা, কোন ভাগবাটোয়ারার মধ্যে নেই, কারো উপর জুলুম করি না, কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করি, ঠিক মতো অফিসের কাজ করি, এগুলো কি কম আত্মতৃপ্তির ব্যাপার?
কিন্তু এ আত্মতুষ্টি আমাদের কালোকে কালো আর সাদাকে সাদা বলার ক্ষমতাকে বন্দী করছে জাস্ট নিজের পজিশনটার গায়ে অন্যের প্রশংসার ট্যাগ লাগানো জন্য। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম আমিও সম্ভবত ঐ দলের। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, মৃত্যুকালে কাউকে যখন তার বিগত দিনের পাপের কথা মনে করতে বলা হয় অধিকাংশ লোক কার সাথে অবৈধ ফিজিক্যাল সম্পর্ক করেছে সে বিষয়ে ভাবে কিন্তু কার হক নষ্ট করে, কার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে এসব তার মনোবেদনার কারন হয় না। আমাদের চমৎকার মাইন্ড সেট, ঘুষ খাচ্ছি না, সময়মতো অফিস করছি, অন্যায় সুবিধা নিচ্ছি না (পড়ুন সরাসরি অন্যায় সুবিধা নিচ্ছি না) এটাই তো সততা।
আমার সব ঠিক আছে। দুর্বলের বাড়িঘর বর্গীরা সব লুটে নিয়ে যায়। আমার কি? আমি তো আর লুট করছি না । ঈমানী দায়িত্ব হিসাবে লুন্ঠিতদের সান্ত্বনা দিয়েছি, এ বা কম কিসে?
বন্ধুদের সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছি, কে বিল দেবে? যার কাঁচা পয়সা বেশী। বিল দেয়ার তার জোড় বেশী আর আমাদের মৌন সম্মতি। পশ্চাতে আবার তাকে চোরের বাচ্চা বলে গালি না দিলে নিজেকে ধোয়া তুলসি পাতা প্রমাণ করা যায় না। আবার খেয়ে পড়ে তাদেরকেই ল্যাং মেরে ফেলে দেয়ার মধ্যে জিহাদের আত্মতৃপ্তি অহরহ নিতেই থাকি।
পরিবারে, সমাজে, দপ্তরে ১৫ টাকার ক্যাপিটাল নিয়ে ১৫ শ টাকার বড় লোকি ভাব দেখাতেই হবে। ভরসা আশপাশের চোর ডাকাত। এখানে ওত পেতে থাকে পারস্পরিক Expectation। তখন আর চিপস অ্যাডের মত বলতে হয় না, একা একা খেতে চাও দরজা বন্ধ করে খাও। চোর ডাকাতদের কাছে এখানে তথাকথিত সৎদের পরাজয়। ওরা জানে সকলের ধমতিতে প্রবাহিত হয় ওদের টাকার ক্যালরি। ১০০০ টাকার সুবিধা যদি ১০০ টাকার চাঁদা দেয়ার আত্মতৃপ্তি সম্বল করে ভোগ করতে পারি তো সমস্যা কোথায়। মনে পড়ে একবার ১১০০ টাকার চাঁদা দিয়ে একটা পিকনিকে অংশগ্রহণ করেছিলাম। পরে শুনেছিলাম জনপ্রতি খাবার খরচ ছিল ২৩০০/-। কোথা হতে এ টাকা এসেছি জানার প্রয়োজনও বোধ করিনি যদিও ১০০% বিশ্বাস অন্তত একাজে চ্যারিটি ওয়ার্ক কেউ করবে না। ঐ খাবার গ্রহণ করেও নামাজে শান্তি খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করেছি এ তুষ্টিতে যে, আমার টাকাতো আমিই খেলাম!
যোগ্য মানুষের হক মেরে এলাকার লোকের চাকুরি দেয়া, আকাশের কাছে বাতাসের কাছে ফেরেশতা সমতুল্য গুনগান, খুব ভালো মানুষ, জানিস কত মানুষের অন্নের জোগান দিয়েছেন। ১৫ হাজার টাকার চাকুরী করে এলাকার মসজিদে পনেরো লাখ টাকা দান গ্রহণের আগে ঐ টাকার উৎস সন্ধানে কখনো যাই না। সন্ধানেও যেতে হয় না। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে মানুষতো অত বোকা নয়। কিন্তু সব কিছু বুঝতে যেতে নেই, অন্তত যে বোধগম্যতায় নগদ প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হতে হয় তাতো নয়ই।
আমাদের এলাকায় অনেক প্রচলিত একটি গল্প বলে আজকের লেখার ইতি টানতে চাচ্ছি, খুব ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ একদিন বাড়ি ফিরে তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, আজ কি দিয়ে ভাত। উত্তর আসলো, মুরগির ঝোল আর আলু ভর্তা। লোকটা জবাব দিলেন, আমিতো কোন মুরগি কিনিনি, তাহলে আসলো কিভাবে। স্ত্রী উত্তর দিলেন, প্রতিবেশীর এক মুরগি ঘরের মধ্যে ঢুকেছিল, তাকে ধরে জবাই করে রান্না করেছেন। লোকটা ছি ছি করে উঠলেন, এ ঘোর অন্যায়, মহাপাপ। খেতে বসে লোকটি আলু ভর্তা দিয়েই ভাত খাওয়া শুরু করলেন। স্ত্রীর মুরগির মাংস চিবানো দেখে বললেন, একটু ঝোল দেয়া যায় না? স্ত্রী বললেন, তুমি নাকি খাবে না, এটা হারাম বলে। লোকটা জবাব দিলো, ঝোল তৈরির মসলা, পিয়াজ, তেল তো আমার টাকা দিয়ে কেনা, তা খাওয়া জায়েজ হবে না কেন। তার স্ত্রী পাতিল একটু উপড় করে লোকটার পাতে যখন ঝোল ঢেলে দিচ্ছেলেন, তখন এক টুকরো মাংসও লোকটার পাতে পড়ে গেল। স্ত্রী যখন মাংসটা তুলে নিতে গেল লোকটা বাধা দিয়ে বললেন, যা না চাইতেই নিজে নিজে আসে সেটাতো হালাল হয়ে যায়।
এই লেখাটা আসলে আমাকেই চেনাচ্ছে ও ভাবাচ্ছে…! ভালো থাকা কঠিন। এই একটু ঝোলকে গ্রহণযোগ্য ও ইনিয়ে বিনিয়ে জায়েজ বানানো লোক এ সমাজে অহরহ! আল্লাহ সবাইকে ছোট-বড় দুর্নীতি ও মন্দ স্বভাব থেকে রক্ষা করুক।
পাপ বোধ ও তার থেকে দূরে থাকা এবং দূরে থাকার চেষ্টা করা একটা ইবাদতের অংশ। আল্লাহ পাক সবাই বোঝার তৌফিক দান করুন।