Skip to main content

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে পাহাড়ে, পরীক্ষার শেষ ঘন্টার মত দ্রুত লয়ে। আমারা ফিরছি ত্রিপুরাপাড়ায় পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একটা টিলার টানে। সূর্যোদয়ের পর আর সূর্যাস্তের আগে এক টুকরো নীরবতায় পাহাড়ে অলস সময় কাটানোর মত পুলকিত, সম্মোহনী আর প্রশান্তিময় কাজ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। আপাতত সেই আকর্ষণেই ছুটছি।

ত্রিপুড়াপাড়ায় এসে, ঠাণ্ডা জলে কাঁকর বিছানো একটা ঝিরিপথে দ্রুত চলতে হলো। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে! পথ চলার মৃদু ছন্দে জল ভাঙ্গার শব্দ আর পাখিদের ঘরে ফেরার বিচিত্র কলোরব চারদিকের নিস্তব্ধতায় অভূতপূর্ব অলংকরণ যুক্ত করেছে। চিন্তার চেয়েও ক্ষিপ্র ভঙ্গিমায় সন্ধ্যা নামছে। প্রায় এক কিলোমিটারের ঝিরিপথ শেষ হলো। খুব সরু একটা পথ ধরে টিলায় উঠতে লাগলাম। পথে টিলার ঢালে আম বাগান। এরপর একটা রিজ লাইন পেরিয়ে টিলার মাথায় আমাদের আশ্রয়! আমাদের নিমন্ত্রণ দাতার “গ্রিন ভ্যালি ক্যাম্প”। গোসল আর নামাজ সেরে এক মগ চা নিয়ে বসলাম। সামনে সুউচ্চ হাতিমারা পাহাড়। বিদায়ী সূর্যের শেষ আলোর লুকোচুরি সেখানে। মেঘলা আকাশ থাকায় শেষ বেলার আলোর খেলা বেশিক্ষণ দেখা গেল না। কিন্তু গুমোট আলো, সভ্যতার শব্দহীন সময়, বিস্তৃত পাহাড় শ্রেণি আর তাতে সবুজের মেলা, নীড়ে ফেরা পাখিদের কলোরবের বহুরূপতা যেন এক আনন্দময় ট্র্যাজেডির জন্ম দিয়েছে। ধীরে ধীরে নীরবতায় সমর্পিত প্রকৃতি অনেক দূরের ফেলা আসা স্মৃতি, আপনজন, দুঃখ, কষ্ট, সুখ অবলীলায় মনে করিয়ে দেয়! আর বার বার মনে হয় ছোট্ট এ জীবনে অনেক কিছুর কী খুব দরকার? আলহামদুলিল্লাহ! বেশতো জীবন যাচ্ছে! মাগরিবের পর হাতিমারা পাহাড়ের ঠিক মাথায় চাঁদ উঠলো!  নাম না জানা পাখির ডাক, ঝিঁঝিঁর শব্দ, অন্ধকারে আরো নিকষ হওয়া পাহাড়ের লতা-গুল্ম-গাছ আর পূর্ণ শরীরের এ চাঁদ কি যে অপরূপ সৌন্দর্য আর অনুভূতির অভূতপূর্ব মিলন সৃষ্টি করেছে তা শুধু লেখায় বা শব্দের গাথুতিতে বলা অসম্ভব! এ ভালো লাগার সময় বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। আস্তে আস্তে সমগ্র আকাশ মেঘে ছেয়ে গেল। অপেক্ষা করতে লাগলাম মুক্ত আকাশের জন্য। নাহ! ভাগ্য খারাপ, বৃষ্টির ফোটা পড়া আরম্ভ হলো। আকাশ পরিষ্কার হবে, স্বচ্ছ আকাশ ভরা জোৎস্নায় পাহাড়ে নির্জন রাতটা কাটাব অনাবিল আনন্দে, এমন প্রত্যাশায় একটু পরপর বাহিরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে করতে রাতের খাবারের সময় হয়ে গেল। কয়েক দফা চা-নাস্তার পর্ব শেষ হয়ে ডিনারের আহবান এলো। সাথে সাথে নামলো ঝুম বৃষ্টি, সাথে তীব্র বজ্রপাত! প্রতিটি বজ্রপাতে গ্রিন ভ্যালি ক্যাম্পের কাঠের দেয়াল এমনভাবে কেঁপে উঠছিল যেন দেয়ালেই বজ্রপাত হচ্ছে। বিজলির আলো, বৃষ্টিস্মাত পাহাড়, বজ্রের শব্দ, মাঠির গন্ধ আর পাহাড়ের উপর মধ্যরাত চিন্তায় আর অনুভবে যে অনুভূতির সৃষ্টি করছিল তা দীর্ঘসময় মোহগ্রস্ত করে রেখেছিল। রাতের জার্নি আর সারা দিনের ক্লান্তিতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। বৃষ্টির গান শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।

ঘুম ভাঙ্গলো পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে। চোখ না খুলেও শুধু অনুভূতি দিয়ে টের পাচ্ছিলাম প্রকৃতির ক্রমশ জেগে ওঠা! গতরাতের বৃষ্টিতে সজীবতা আর প্রাণের সঞ্চার হয়েছে পাহাড়ের সবুজে! সুর্যের প্রথম আলোর নরম স্পর্শ যেন সবুজের বিশাল ক্যানভাসে অবলীলায় খেলা করে অপরূপ সব ক্ষণজন্মা চিত্রের জন্ম দিচ্ছে।

তাড়া এলো, কাছেই একটা ঝর্ণা আছে। সকালের নাস্তার আগেই ঘুরে আসতে হবে। টিলা হতে নেমে প্রায় ১ কিলোমিটার ঝিরি পথ ধরে গেলেই পাওয়া যাবে।

প্রথমে কর্দমাক্ত পথ, পরে কাঁকর বিছানো ঝিরিপথের ঠাণ্ডা জলে হাঁটতে হল। সকালের স্নিগ্ধতায় ৩০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম ঝর্ণার পাদদেশে। ছোট কিন্তু বৈচিত্র্যময় টু-স্টেপ ঝর্ণা। আধো আলো আধো ছায়ায় মহাকালের স্মৃতি মেখে যেন অনন্তকাল ধরে অপেক্ষারত কোন আশ্রয়। ঝর্ণার ২য় ধাপের বেজে এসে মনে হলো একটা তাঁবু খাটিয়ে এ নির্জনতায় শুধু জল পতনের শব্দ শুনে অনায়াসে  কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেয়া যায়! দিনের আলো এখানে খুব কমই আসে। সিক্ত পাথুরে দেয়ালে অসম্ভব এক পুঞ্জিভূত মায়া! নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করে ফেলে।

গ্রিন ভ্যালি ক্যাম্পে ফিরে এসে, রওনা দিলাম সাপছড়ি মইন পাড়ার উদ্দেশ্যে! প্রথমে সিএনজি চালিত ট্রাই সাইকেলে সাপছড়ি উপর পাড়া, তারপর দীর্ঘ ঝিরিপথের প্রবেশ দ্বার। এ এক অনাবিল আনন্দে রোমাঞ্চকর পথচলার অনুভূতি!

shisir mehdi

মো: মেহেদী হাসান। জন্ম করতোয়া ‍পাড়ের পুন্ড্রবর্ধনের স্মৃতিমাখা বগুড়ায়। সরকারী আজিজুল হক কলেজ হতে রসায়নে স্নাতকোত্তর। খন্ডকালীন এমফিল করছেন রুয়েটে। বগুড়ার বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রভাষক পদে চাকুরির মাধ্যমে কর্ম জীবনের শুরু। বর্তমানে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে কর্মরত। শিশির মেহ্দী ছদ্মনামে লেখালেখির শুরু করেছিলেন। প্রকাশিত বই চক্র ( ছোট গল্প) এবং নির্বাসনে আছি (কবিতা)। পানি নিয়ে একটা গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক জার্নালে। লেখালেখি, ভ্রমণ ও ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফিতে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে।

One Comment

  • ফোরকান says:

    পাহাড়! তুমি অপরূপা! মনোহর! লিখাটি পড়তে পড়তে কখন যেন মজে গেলাম কলকল ছলছল ঝর্ণাধারায় আর ঘন সবুজের গহীনে…

Leave a Reply to ফোরকান Cancel Reply