অনেকদিন পাহাড়ে যাওয়া হয়নি। পাহাড়-অরণ্যে মাখামাখি ঝিরিপথে ঠান্ডা জলে পা ভিজিয়ে নুড়ি আর জলের আলিঙ্গনের গানও শোনা হয়নি বহুদিন। অন্ধকার নিস্তব্ধ রাতে কান পেতে অরণ্যের কথাও শোনা হয়নি, দেখা হয়নি আকাশ মনের মত করে বিস্ময়াভিভূত আনন্দে। মৃদু বাতাস থাকবে, মাথার উপর বিশাল আকাশের ক্যানভাস, তাতে রূপার প্রলেপে তারাদের জীবন্ত চিত্রকর্ম।
প্রায় এক বছর হতে চললো, এমন সব অতৃপ্ততায় বহু পরিকল্পনা আর স্বপ্ন চিন্তার রাজ্যে শাখা প্রশাখা বিস্তৃত করছিল। অবশেষে এক পরিকল্পনা আল্লাহর রহমতে সাফল্যের মুখ দেখলো। বৃহস্পতিবার রাত ১১.৪০ এ কলাবাগান হতে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। দলে আমরা ০৮ জন, যদিও ৯ জন যাওয়ার কথা। শেষ মূহুর্তে একজন বাসা হতে এনওসি না পাওয়ায় আসতে পারেননি।
চট্টগ্রাম পার হয়ে কাপ্তাই এর আগে হাছি ফকির দরগাহ জামে মসজিদে ফজর নামাজের বিরতিতে গাড়ি দাঁড়ালো। ওজুর সময় পুকুরের জলে শৈশবের গন্ধ পেলাম। নামাজ শেষে সদ্য ফোটা সকালের আলোয় পাহাড়, গাছ-গাছালির মিতালি মাখা পথে গাড়ি এগুতে থাকলো আবার। অনেক জায়গায় পাহাড়, টিলা ঝোপ-ঝাড় কেটে ইট পাথরের বসতি/ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। এক সময় কি আমাদের বন আর পাহাড় দেখার জন্য মিউজিয়ামে রক্ষিত রেপ্লিকার কাছে ছুটে যেতে হবে? হয়তো তাই। এই বন আর পাহাড় খেকোদের থামাবে কে?
টিলার উপড় দাদার ফার্মহাউসে যখন পৌঁছালাম তখন বেশ বেলা উঠেছে। সকালের নাস্তার তোড়জোড় চলছে। এ অবসরে হাতিমারা পাহাড়মুখী বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক কথায় জাস্ট থ হয়ে গেলাম। সামনের পাহাড়ের উপর ঝুলে থাকা আকাশ মুগ্ধতার সব রং নিয়ে আমার অনুভূতিতে পাখা মেললো। দীর্ঘ দিন, অনেকদিন, প্রায় এক বছর, একটু সুন্দর আকাশের জন্য এত বেশি তৃষ্ণাতুর ছিলাম যে, সে দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। পশ্চিম-পূর্বাকাশে ছড়ানো ধূসর মেঘ, তার বিচ্ছিন্ন অবয়ব স্পর্শ করে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সকালের সূর্যের আলো। পূর্ব দিকে ঠিক পাহাড়ের উপর নীল আকাশ তার উপর মহান আল্লাহ যেন রং তুলিতে সাদা মেঘের হালকা ছোয়া দিয়েছেন। লতা-গুল্মে আচ্ছাদিত সবুজ পাহাড় হতে সহসায় চোখ চলে যায় ছাই আর সাদা রং এর অদ্ভুত কারুকার্যময় মেঘে, তারপর অসীম নীলাকাশ, যেখানে অনন্তে হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে পরাজিত হচ্ছে নীল প্লাটফর্মে মেঘ বালিকার চিত্রকর্মে।
আমাদের ডেরার পাদদেশে নুড়ি বিছানো সংকীর্ণ ঝিরিপথ ধরে সকাল ১০.২০ এর দিকে আমাদের ট্রেকিং শুরু হলো। গন্তব্য বুড়ির নাক ঝর্ণা হয়ে হাতামারা পাহাড়ের শীর্ষ। ঝিরিপথে পানি খুব বেশি না। বহমান জলের বুকে সুর্যের আলোর প্রতিফলন মন ভালো করে দিলো। পথের দুইপাশে ঝোপ জঙ্গলে যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সকালের সূর্যালোক। ঝিরির পথকে স্পর্শ করার কি নিরন্তর প্রচেষ্টা তার! সংকীর্ণ ঝিরিপথের দুপাশে ঢেঁকি শাকের মত ফার্নগুলো যেন এ চলার আইডেন্টিটি। ছোট বেলায় পুরাতন কুপের গায়ে এ ফার্ন দেখে কেমন জানি শিহরিত হতাম। মাঝে মাঝে বুনো কলার গাছ, কৃত্রিমভাবে লাগানো সেগুন গাছ। পথের ধারে লজ্জাবতীর পিংক বর্ণের ফুলে অনেক দিনের স্মৃতিতে চলে যেতে হলো। কোথাও গাছে জড়ানো লতায় অনেকটা ছাতিম ফুলের মত ফুল ফুটে আছে। বেশ লাগলো। আমাদের সাথের এক দাদা বললো, এটাকে স্থানীয় ভাষায় নাকি মুদুইনুয়েহ বলে। কোথাও কেটে গেলে এ লতার পাতার রস রক্ত বন্ধের প্রাথমিক চিকিৎসায় বেশ কাজ দেয়। গামারি , কড়ুই, জোয়ানা (স্থানীয় ভাষায়) গাছ আছে বেশ।
কোথাও বাঁশঝাড়, কোথাও লতা-গুল্ম পথকে তিন দিক হতে বেষ্টন করে আছে। চলতি পথে কোথাও এ শৃঙ্খলের মাঝ দিয়ে অসীম সুন্দর আকাশ দেখা যায়। কী অপরূপ নীল সে আকাশ, তাতে ছোপ ছোপ হাল্কা সাদা মেঘ। মাঝে মাঝে পথের উপরে সবুজের ছাউনি আর তার উপর মধ্যগগনের সূর্যালোকের হুমড়ি খেয়ে পরায় সে ছাউনি অপুর্ব হলুদাভ-সবুজ রং ধারণ করেছে। ঝিরি পথে অনিয়মিতভাবে বেশ বড় বড় বোল্ডারও আছে। পার হতে বেশ বেগ পেতে হয়। অথচ মাথায় স্ট্র্যাপ দিয়ে থুরুং পিঠে নিয়ে কিছু স্থানীয় নারী অবলীলায় ১৫/২০ কেজি মালামাল এ পথ দিয়েই নিয়ে যাচ্ছে। স্যালুট তাদের জীবন সংগ্রামকে।
পথের দুপাশে কোথাও কোথাও পাথুরে দেয়ালে মহাকালের মসৃণ কারুকার্য! কতদিনের জল, ঝঞ্ঝা আর সংগ্রামের আলেখ্য যেন তাতে খুদিত। এরপর ট্রেইলে বড় বড় পাথরের রাজ্য শুরু হলো। সেসব পাথরের গায়ে জলের স্পর্শ অদ্ভুত এক সুর ঝংকার সৃষ্টি করেছে। চারপাশের নীরবতায় সে সুর মনে কেমন জানি শীতলতার পরশ বুলিয়ে যায়। মনে হলো, কত মহাকালের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এসব পাথরের সঙ্গে, কার প্রথম পদচিহ্ন পড়ে ছিল এখানে, কে জানে?
২০১৭ সালের জুন মাসের পাহাড় ধসের স্মৃতি এখনো জীবন্ত ঝিরিপথে। পাহাড় হতে খসে পড়া বড় বড় খণ্ডাংশ পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। উন্নত শিরের পাহাড়ের খণ্ডাংশে ঘাস-লতা- গুল্ম গজিয়েছে। এই পথের মাথায় বুড়ির নাক ঝর্ণা একটা ছোট খুমের সৃষ্টি করেছে, আধো আলো আধো ছায়ায় স্বচ্ছ পানির সে জলাধারের সৌন্দর্য অপার্থিবই বলা যায়। আমাদের দলের কেউ কেউ তো নগদে এ রূপের জলে ঝাঁপ দিতে চাইলো। যাই হোক, ফিরতি পথে সে সুযোগ কাজে লাগানোর বাসনা নিয়ে সবাই সামনের দিকে এগুলাম আমরা।
বুড়ির নাক ঝর্ণার ঠিক আগে একটা ভয়াবহ গিরিখাতে জল জমে খুমের সৃষ্টি করেছে। তার পাশ ঘেঁষা খাড়া পাথরের দেয়ালের খাজে পা রেখে পার হতে হলো। এই পার হওয়াকে এভাবে হয়তো অনুভূতিময় করা যায়: কষ্টকর, ভয় জাগানিয়া, রোমাঞ্চকর এক পারাপার। গিরিপথে দুই পাশে পাথরের গায়ে পানি আর প্রকৃতির কারুকার্য মন ভালো করে দিল। ভাবলাম, বর্ষায় এ রুট কি মারাত্মক রকমের হয়ে ওঠে। এখানে জলের গান এক অপরুপ ইকো সৃষ্টি করছে। মনে হয় , কান পেতেই থাকি!
এরপর আবার ঝিরিপথ। রাস্তা হতে গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে অপূর্ব নীল আকাশ দেখা যায়। বুদ্ধদেবের কবিতা মনে উঁকি দিল, ‘কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর’। একটা গিরি খাতে এসে পড়লাম, ঠিক বুড়ির নাক ঝর্ণার আগে। খাদ হতে উপরের দিকে যে পাহাড়ের দেয়াল উঠে গিয়েছে, তা হতে যে কোন সময় ধস হতে পারে। সংকীর্ণ খাদ পার হয়ে ঝর্ণায় আসলাম। তঞ্চঙ্গারা বলে বুড়ির নাক আর মারমারা বলে হাতির মাথা। পাহাড়ের গায়ে যেখানে ঝর্ণামুখ তাতে কেউ হয়তো নাকের আদল কেউ হাতির মাথার আকার খুঁজে পেয়েছে তাই এরুপ নামকরণ।
হাতির মাথার নিচে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালাম, পাহাড়ের মাথায় গাছ গাছালির পাতলা আবরণ ভেদ করে সরু পথে সূর্যের আলো প্রবেশ করছে। মনে হয় ঐ পাশে অশরীরী কিছু আছে! সে প্রবেশ মুখ দিয়েই আমরা পৌঁছে গেলাম হাতিমারা পাহাড়ের পাদদেশে। জনশ্রুতি আছে এ পাহাড় হতে কোন এক সময় একটা হাতি নিচে পড়ে মারা গিয়েছিল, তাই এই পাহাড়ের নাম হাতিমারা পাহাড়। পাহাড়ে আরহণের প্রবেশ দ্বারেই বিশাল একটা পাথর আমাদের স্বাগত জানালো। (চলবে)
লেখাটা এককথায় অসাধারণ। এটাই কি আপনার সেরা লেখা কিনা? পড়তে পড়তে মনে হলো আমি মিশে গেছি সেই স্নিগ্ধ, শান্ত, অপরূপ প্রকৃতির মাঝে। যেতে চাই পাহাড়ে…
ধন্যবাদ ডিয়ার।